Skip to main content

বই রিভিউ#২৪: উমরের সাথে যখন দেখা হলো


বই রিভিউ #২৪

বই: উমরের সাথে যখন দেখা হলো

আমিরুল মুমিনিন উমর ফারুকের হৃদয়ছোঁয়া জীবনকাহিনি

লেখক: ড. আদহাম আশ শারকাবি


  • বইঃ উমরের সাথে যখন দেখা হলো (আমিরুল মুমিনিন উমর ফারুকের হৃদয়ছোঁয়া জীবনকাহিনি)
  • লেখকঃ ড আদহাম আশ শারকাবি
  • অনুবাদকঃ আমীমুল ইহসান
  • প্রকাশনীঃ রুহামা পাবলিকেশন
  • পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৩৮৩
  • মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৬৭ টাকা

উমর ইবন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। কেবল একজন অতুলনীয় ব্যক্তির নাম নয়, যোগ্যতার শীর্ষে পৌঁছানো শাসকের নাম নয়, এ এক অনুভূতির নাম, আবেগের নাম। অত্যাচারিত মাজলুমের দীর্ঘশ্বাস আল্লাহর কাছে যেই শাসকের জন্য আর্তি করে, প্রতিটা এতিম যার জন্য দূর দিগন্তে তাকিয়ে থাকে, তিনিই আমিরুল মুমিনিন উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক অতি আপনজন। চার খলিফার একজন। মানব ইতিহাসে দীপ্তিমান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁরই জীবনী নিয়ে তাঁর সাথে গল্প করতে করতে আমরা শেষ করব "উমরের সাথে যখন দেখা হলো"।

বই সম্পর্কেঃ

এক কৌতুহলী যুবক পথ হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় এক আগন্তুককে। বইয়ের ভাষায়

দীর্ঘকায় শরীর তাঁর—যেন উঁচু উঁচু খেজুর গাছের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে! শক্তপোক্ত- যেন শক্ত পাহাড়ের কোমর খোদাই করে তৈরি হয়েছে তাঁর অবয়ব!

বাম হাতে শোভা পাচ্ছে একটি লাঠি। তবে মাটির ওপর যেভাবে লাঠি রাখছেন, তা দেখে তোমার মনে হবে, তিনি লাঠিটা স্রেফ মাটিতে গেঁথেই চলেছেন—যেন পৃথিবীকে আপন কক্ষপথে স্থির রাখতেই তিনি এটি ব্যবহার করছেন!

কাছে আসতেই দুজনের আলাপ হয়। যুবক সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে আগন্তক আর কেউ নন, স্বয়ং আমিরুল মুমিনিন উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। এক কিংবন্দন্তী মহাপুরুষ যুবকের সামনে উপস্থিত।

কথোপকথন এগিয়ে চলে। ইসলাম গ্রহণ থেকে আরম্ভ করে একাধিকবার তাঁর কথায় আল্লাহর পবিত্র কুর'আনে সরাসরি আয়াত হিসেবে নাজিল হওয়া, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খলিফা হওয়া, তারপর উমর রাদ্বিয়াল্লাহুর নিজের খিলাফত গ্রহণ- এগিয়ে চলে ধারাবাহিকভাবে যুবক ও আমিরুল মুমিনিনের সংলাপ।

জ্ঞানপিপাসু যুবক একের পর এক প্রশ্ন করে চলে আমিরুল মুমিনিনকে। উঠে আসে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মুখে তাঁরই জীবনের নানাদিক। তাঁর যুদ্ধকৌশল, রাজনীতি, সমরনীতি, যুগান্তকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ যা খিলাফতের কাজকে ত্বরাণিত করেছিল সেগুলোর আলোচনা, অর্ধপৃথিবী শাসনের কাহিনি, কোনোকিছুই বাদ যায় না সেই কথোপকথন থেকে। যাবেই বা কেন? আমিরুল মুমিনিনের দেখা তো পাওয়া কালে একবারও সম্ভব না এখন, সেখানে যুবক কিভাবে হাতছাড়া করে এই সুবর্ণ সুযোগ? ব্যক্তিজীবন, আল্লাহর দাস হিসেবে তাঁর জীবন, খলিফার জীবন সবই উঠে এসেছে বইয়ের পাতায় পাতায় পরিষ্কার ও সাবলীল ভাষায়।

জীবনের ঘটনায় উঠে এসেছে ইনসাফের  উদাহরণ, পরহেযগারিতার দৃষ্টান্ত। এক অতি বিশুদ্ধ, শুভ্র-নির্মল জীবনের মুক্তো ঝরছে বইয়ের পাতায় পাতায়। যুবক বার বার মুগ্ধ হয়েছে, অভিভূত হয়েছে এমন এক মহাপুরুষের জীবনদর্শন জেনে।

কখনো উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথার মানে বা কোনো কাজের কারণ বুঝতে না পারলে যুবক প্রশ্ন করেছে। আমিরুল মুমিনিন সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে করেছেন সংশয়ের অপসারণ। এভাবে লেখক তাঁর বইয়ে এক অভাবনীয় জ্ঞানের গভীরতা তৈরি করেছেন।

কেবল উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জীবনীই নয়, শেষে এসেছে এই মহাপুরুষের নামে রটা কুৎসা ও অপবাদের খণ্ডন, যা এই সংলাপনির্ভর বইকে পূর্ণতা এনে দিয়ে করেছে সার্থক। করেছে পুরো ব্যতিক্রমী একটি বই আত্মজীবনী বইয়ের রাজ্যে।

সমাপ্তিতে বেদনার মূর্ছনা তুলে শাহাদাতের অমিয়সুধা পানের ঘটনা শুনিয়ে যখন চলে যান উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, তখন যুবকের মতো পাঠকও ডেকে উঠবে "হে আমিরুল মুমিনিন... হে আমিরুল মুমিনিন"।এ এক অসম্ভব সুন্দর বই যা পাঠককে অভিভূত করবেই।

পাঠ্যানুভূতিঃ

আড়াই বছর ধরে এই বই নিয়ে পড়েছিলাম। দোষ কেবল আমার। কারণ এতো চমৎকার বই পড়তে কখনোই এতো সময় লাগার নয়। যাইহোক, আলহামদুলিল্লাহ ২০২৫ এর পড়া শেষ করা প্রথম বই হলো "উমরের সাথে যখন দেখা হলো"।

প্রথমেই বলব যে আমি লেখকের গুণমুগ্ধ এক ভক্ত হয়ে গিয়েছি। আত্মজীবনীর মতো নিরস জিনিসকে এতো দূর্দান্তভাবে সংলাপে সংলাপে সাজানো রীতিমতো এক বীরত্বের কাজ। হ্যাঁ, বীরত্বই। কারণ সংলাপে যে আমিরুল মুমিনিনের কথা বলানো হয়েছে সেটা কিন্তু সত্য কাহিনীই বলা তবে উপস্থাপক হলেন কাল্পনিক জগতে বর্তমান। নিজের সাথে কখনো উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দেখা হলে একজন জ্ঞানপিপাসু কিভাবে কি কথা বলত, সেটায় বাস্তবে লিখে হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন ড আদহাম আশ শারকাবি। এক অসাধারণ কাজ হয়েছে! মাশা আল্লাহ!

শুধু কি তাই? সংলাপগুলো কিন্তু ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মেনে চলেছে। তাছাড়া জীবনী পড়তে গিয়ে ব্যক্তি উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যেসব কাজে আমাদের "কেন এমন করলেন তিনি?" প্রশ্ন আসতে পারে, সেসবই এসেছে যুবকের মুখ থেকে। তাই পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, সেই যুবকের জায়গায় আমিই দাঁড়িয়ে আছি। আর কথা বলছি আমার খুব পছন্দের এক ব্যক্তিত্বের সাথে।

উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জীবনের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম আমি একেবারে তলায় গিয়ে উপলব্ধি করেছি যে সত্যিকার পরহেজগারিতা কি। ইনসাফের স্বরূপ দেখলাম এই বই পড়ে। বইয়ের যুবকের মতো বার বার আমিও বিহ্বল হয়েছি উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জীবনীর নানাদিক জেনে।

শেষে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের কথা পড়তে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছে, চোখ ঝাপসা হয়য়ে গিয়েছে। তারপর শেষ করে আফসোস হচ্ছে, যদি এই বই কোনোদিন শেষ না হতো। ইশ! যদি শেষ না হতো যুবকের আর আমিরুল মুমিনিন উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর এই সংলাপ...

প্রচ্ছদটা নজর কাড়া। সাথে বাধাই ও মুদ্রণও টপনচ। অনুবাদক প্রশংসার দাবিদার কারণ পড়তে গিয়ে একবারের জন্যও মনে হয়নি যে কোনো বইয়ের অনুবাদ পড়ছি। মূল বইই যেন এটা- এমন লেগেছে।

সবমিলিয়ে একটা অনবদ্য বই পড়ে শেষ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ। 


Comments

Popular posts from this blog

বই রিভিউ #০১: সংশয়বাদী

  বই রিভিউ #০১ বই:সংশয়বাদী লেখক: ড্যানিয়েল হাকিকাতযু    বই: সংশয়বাদী লেখক: ড্যানিয়েল হাকিকাতযু অনুবাদ: আসিফ আদনান প্রকাশনী: ইলমহাউজ পাবলিকেশন পৃষ্ঠা: ২৬৫ আজকের দিনে আমাদের চারপাশে দেখলে দেখব বিভিন্ন মত, আদর্শের (ideology) র জগাখিচুড়ি। এতোশত "Ism" যে গুণে শেষ করা দায়। Ism এর লেজ লাগানো শব্দগুলো কিন্তু আবার খুব eye catching। যেমন Feminism, Liberism, Harm principle, Nihilism, Modernity ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা কেবল এইসব চটকদার শব্দের উপরের মোড়ক দেখে ভাসাভাসা বুঝে স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে হয়ে যায় এইসব মতাদর্শী। আর এই প্রত্যেকটা মতই একেকটা ideology নিয়ে ঘুরে। পুরো একটা দর্শন, একটা worldview দেয়। কিন্তু আমরা ভাবি এইগুলো কেবল কিছু "ভালো" আদর্শ। মামুলি ব্যাপার!   প্রতিটা "ism" যেহেতু একেকটা worldview দেয় আর ওদিকে ইসলাম একটা পরিপূর্ণ দ্বীন বা worldview, তাই ইসলামের সাথে এইসব "ism" এরই দ্বন্দ্ব বাঁধে। কারণ "ism" গুলোকে যতোই নিদেনপক্ষে নিরীহ লাগুক না কেন, আসলে সেগুলো পুরো দুনিয়ার প্রতিটা মানুষের মেনে নেওয়ার দাবি করে। এদিকে জীবনের প্রতিটা ছোট-বড় কাজ, রা...

বই রিভিউ #০৮: কষ্টিপাথর-২: মানসাঙ্ক

  বই রিভিউ #০৮ বই: কষ্টিপাথর-২: মানসাঙ্ক লেখক: ডা.শামসুল আরেফীন বই: কষ্টিপাথর-২: মানসাঙ্ক লেখক: ডা.শামসুল আরেফীন (ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজ) প্রকাশক: সন্দীপন প্রকাশন পৃষ্ঠা:২২৪ ধর্ষণ সমাজের এক অন্যতম ব্যাধি। যার প্রতিকার হাতড়ে বেড়াচ্ছে প্রাচ্য থেকে প্রতিচ্য, প্রতিটা সমাজ। সেক্যুলার world দিচ্ছে একেকটা নতুন উপায় বাতলে ধর্মের দেখানো পথ থেকে বেরিয়ে। কিন্তু তাতেও তো কমছে না এই রোগ। প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই কমপক্ষে একটা ধর্ষণের খবর চোখে পড়বেই।  যেকোনো ধর্ষণের ঘটনার পরে দুইদলের আবির্ভাব হয়। একদল কেবল ভুক্তভোগীর পোশাকের দোষ দিয়ে নিস্তারের পথ খোঁজে। কেবল পোশাকই যদি সব গণ্ডগোলের মূল হয়, তবে কয়েকদিন আগের সেই তৃতীয় শ্রেণীর ফুটফুটে বাচ্চার কোন উত্তেজক পোশাকে পিশাচগুলোর পাশবিকতার শিকার হতে হয়েছিল তাকে? এখন তো কুকুর-বিড়াল-গুইসাপও এই ধর্ষণের তালিকা থেকে বাদ যায় না। তাদেরও কি তাহলে পোশাকের দোষ? আরেকদল কেবল ধর্ষককে, ছেলেদের মেন্টাল সেটআপকে পরিবর্তনের কথা গলা ফাটিয়ে বলে। কিন্তু তথ্য, উপাত্ত ও experiment থেকে উঠে এসেছে যে কেবল ৮% ধর্ষক বাদে বাকি ৯২% হলো মামুলি মানুষ। মামুলি বলতে বোঝাতে ...

সাজিয়ে ফেলুন জিলহজ্জের প্রথম দশদিন

  সাজিয়ে ফেলুন  জিলহজ্জের প্রথম দশদিন Plan your first decade of Dhul Hijjah #Spiritual  দেখতে দেখতে চলে আসছে জিলহজ্জ্ব মাস। চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে এই মাস জুনের ৭ নাকি ৮ তারিখে শুরু হতে যাচ্ছে। জিলহজ্জ্ব বা যুল হিজ্জার প্রথম দশদিনের তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য নিয়ে কুর'আন ও হাদিসের বহু জায়গায় বলা হয়েছে। এই দশ দিনের মর্যাদা খুব ছোট করে উল্লেখ করছি। জিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের মর্যাদা: সুরা আল-ফাজরের শুরুতেই আল্লাহ তা'য়ালা দশ রাতের কসম খেয়ে বলেছেন, কসম ভোরবেলার, কসম দশ রাতের। (সুরা ফাজর, আয়াত ১,২) ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, কাতাদা ও মুজাহিদ প্রমুখ তাফসিরবিদদের মতে, এই দশ রাত বলতে জিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম দশদিন বোঝানো হয়েছে।  হাদিসের ভাষায় এই দশ দিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দিন। হাদিসে এসেছে, এদিনগুলোতে নেক আমল করার চেয়ে অন্য কোন দিন নেক আমল করা আল্লাহর নিকট এত উত্তম নয়, অর্থাৎ জিলহজের দশ দিন। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয় তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও ...