বই রিভিউ #১৬
বইঃ কখনও ঝরে যেও না
লেখকঃ তারিক মেহান্না
- বইঃ কখনও ঝরে যেও না
- লেখকঃ তারিক মেহান্না
- প্রকাশকঃ সীরাত পাবলিকেশন
- সম্পাদনাঃ জিম তানভীর
- পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ২২৪
বই সম্পর্কেঃ
তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নিগর্ত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কান্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা কৃষকের জন্য আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মু’মিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তরজ্বালা সৃষ্টি করেন...
সুরা ফাতহ, আয়াত ২৯
প্রতিটি মানুষের হৃদয় একটি চাষের ভূমি যেন আর একজন মুমিনের হৃদয় উর্বরতায় উৎকৃষ্ট। সেখানে আল্লাহর ভালোবাসার বীজ পড়ে গজিয়ে ওঠে চারাগাছ। সেই গাছের প্রথম পাতা হয় "আল- ওয়ালা ওয়াল বারা" অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ভালোবাসা আর আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা। এই পাতা গজাতে দেখলে কাফিরদের কলুষিত হৃদয়ে ফুসে ওঠে আক্রোশের আগুন। সে আরো দেখে মুমিনের হৃদয়পটের চারাগাছের দ্বিতীয় পাতা হলো জি হা দের প্রতি ভালোবাসা। এবার কুফরের বাহিনী পাঠায় দমকা হাওয়া গাছের এইসব পাতাগুলো ঝরিয়ে দিতে।
মুমিনের সাদৃশ্য হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদাহরণ দিয়েছে একটি খেজুর গাছের। যেই গাছের পাতা কখনো ঝরে না। মুমিনের হৃদয়ে যেই গাছ বেড়ে উঠছে আল্লাহর ভালোবাসার বীজ থেকে, সেই গাছ কুফরের ঝরো হাওয়াকে পরোয়া না করে হয়ে উঠবে মহীরুহ নিজের পাতাগুলোকে ঝরে যেতে না দিয়ে তাই প্রতিটি মুমিন ও মুসলিমের প্রতি আমেরিকান দাঈ তারিক মেহান্নার উদাত্ত আহবান "কখনো ঝরে যেও না"।
"কখনও ঝরে যেও না" বই মূলত বলে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো, বলতে। জালিমকে ভয় না করে তাকে তার জুলুমের ব্যাপারে প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে এই বই। অনুচ্ছেদ পর পর প্রতিটি সচেতন মুসলিম পাঠককে দেখাবে পরাজিত মানসিকতা থেকে মুক্তি লাভের পথ। বইয়ের খোদ আমেরিকান দাঈ নিজে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তার দেশের শান্তিকামী (!) সরকারের হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ। টেনে ছিড়ে ফেলেছেন এই শান্তিকামী(!) দলের মুখোশ আফিয়া সিদ্দিকীর স্পর্শকাতর কাহিনীর মতো আরো বাস্তব ঘটনা বলে।
বইটাকে লেখক তারিক মেহান্নার একটা ডায়েরি বলা চলে যেখানে তিনি তার কারাবাসের দিনগুলোয় বিভিন্ন ঘটনা থেকে পাওয়া আত্মোপলব্ধি লিখে রেখেছেন। তার পড়া ম্যাগাজিনের কোনো নিউজ থেকে, তার সাথে ঘটা কোনো ঘটনা থেকে, তার দেখা কোনো দৃশ্য থেকে তিনি কুর'আন, হাদিস, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী ও সালাফদের বাণী নিয়ে চিন্তাভাবনার লিখিত রূপ হলো বক্ষ্যমান বই। বইয়ের প্রথমে বাহারি শিরোনামের অনুচ্ছেদ আসার পরে ক্রমান্বয়ে ২৫টা অনুচ্ছেদ এসেছে লেখকের কুর'আনের বিভিন্ন আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর বা চিন্তাভাবনা নিয়ে। ব্যতিক্রমী দৃষ্টি থেকে করা চিন্তা যা আমেরিকান এই দাঈকে বর্তমানকে ইতিহাসের ছাঁচে ফেলে ভাবিয়েছে, সেই ভাবনাগুলো টাইপ হয়ে এসেছে পাঠকের হাতে। তাই "কখনও ঝরে যেও না" বইটি মূলত এক বহুমাত্রিক শিক্ষার ও চিন্তার খোরাকী প্রতিটি পাঠকের জন্য।
বলে রাখা ভালো এই বই সঙ্গত কারণে ২০১৯ সালে প্রথম প্রকাশের পর আর ছাপা হতো না। কিন্তু দেশের ফ্যাসিবাদের নিরসনের পর আবার দ্বিতীয়বার প্রকাশ পায় এই বছরের জুলাইয়ে। তাহলে অবশ্যই বলা চলে এই বই একটি নিষিদ্ধ বই! কিন্তু কেন? কি এমন আছে যা আমাদেরকে এক গোষ্ঠী জানতে দিতে চায়নি? সেটা জানলে পড়তে হবে "কখনও ঝরে যেও না"।
পাঠ্যানুভূতিঃ
বইটার সাজেশন জোরালোভাবে আমি পেয়ে আসছিলাম বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই। পড়ার আগ্রহ ছিল। যখন জানলাম যে এক বিশেষ কারণে এই বই আর ছাপা হয় না, তখন থেকেই আরো আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। তারপর আলহামদুলিল্লাহ এই বছরের ইসলামিক ফাউন্ডেশন বইমেলা থেকে কিনে ফেলি বইটা।
বইটা কেনার আগেই আমি পড়া শুরু করেছিলাম আমার অক্টোবরের মিড সেমিস্টার এক্সামের শুরুর দুই কি তিনদিন আগে থেকে। কারণ আমি এক্সামের দিনে ফেবু ডিএক্ট রাখি আর রিফ্রেশনমেন্টের জন্য পরার ব্রেকে পড়ি নন-একাডেমিক বই।
তো যাই হোক। বইটা আসলেও শিহরণ জাগানোর ক্ষমতা রাখে। কুর'আন,সুন্নাহ দিয়ে বার বার বুঝেয়েছে যে পরাজিত মানসিকতায় পড়ে থেকে কিভাবে আমরা মুসলিমরা মার খেয়ে যাচ্ছি। একজন নেটিভের থেকে তার দেশের কুকীর্তির কথা শুনে, সেটাকে আর কেবল "বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে" বলা চলে না। জানা ছিল এর অনেক কথায়। সেগুলো আবার এই বই আমাকে জানিয়ে নতুন ভাবে। তার চেয়েও ঢের গুণে জানিয়েছে যা আমার ছিল অজানা।
বইটা একটা গ্রাউন্ড ব্রেকিং ইফেক্ট রাখার সক্ষমতা রাখে আল্লাহর ইচ্ছায়। কেউ যদি "চিন্তাপরাধ" বইটা রিসেন্টলি শেষ করে থাকেন, তাহলে তাকে বলব অন্য কোনো বই তুলে নেওয়ার আগে এই বইটা আপনার জন্য মাস্ট রিড!
বইয়ের সবচেয়ে ভালো লাগার ও উপভোগ্য অংশ আমার কাছে কুর'আন নিয়ে আলোচনার জন্য ডেডিকেটেড ২৫টা পার্ট। এমনিও আমার কুর'আনের তাফসির বা আলোচনামূলক লেখা বেশি পছন্দ। তাই এই অংশটায় মোস্ট ফেভরিট হয়ে গিয়েছে। আলোচনাগুলো আমাকে এখন কুর'আন পড়ার সময় আসলেও হেল্প করছে আলহামদুলিল্লাহ। গতানুগতিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে অন্যভাবে ভাবার প্র্যাকটিস হয়েছে আমার বইয়ের এই অংশ পড়ে।
প্রচ্ছদটা সুন্দর মাশা আল্লাহ আর ভিতরে কোথাও বানান ভুল আমার চোখে পড়ল না। যেই ভাই এই বইটার অরিজিনাল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন, সে অবশ্যই অনুবাদে পটু। তাই একবারের জন্যও মনে হয়নি যে এই বইটা আসলে একটা অনুবাদ। কারণ তারিক মেহান্না তো কোনো বাংলাদেশি মানুষ নন। সবমিলিয়ে অবশ্যই বলব পুরো বইটা একটা "বুমেরাং" করবে আপনার মানসজগতে।
আরেকটা ব্যাপার না বলে যাওয়া যায় না, তাহলো এই বইয়ের এন্ডিং। আলহামদুলিল্লাহ জীবনে কম বই পড়া হয়নি,কিন্তু এই বইয়ের এন্ডিং আমি পেয়েছি সবচেয়ে টাচিং। সেটায় কোট করছি শেষে,
সবসময় মনে রাখবেন এবং ইতিহাস থেকেও আমরা এই শিক্ষাটিই পাই যে, শুধুমাত্র একজন মানুষের পক্ষেও পৃথিবীকে বদলে দেওয়া সম্ভব ।
<3
Comments
Post a Comment