বই রিভিউ #১৪
বইঃ মহীয়সী ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাঃ জীবন ও গল্প
লেখকঃ শাইখ আবদুর রউফ আল-মুনাবি
বইঃ মহীয়সী ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাঃ জীবন ও গল্প
লেখকঃ শাইখ আবদুর রউফ আল-মুনাবি
অনুবাদকঃ মুফতি আবদুল্লাহ আল মামুন কাসেমি
প্রকাশকঃ দারুত তিবইয়ান
সিরিজঃ মহীয়সী নারী সিরিজ (৩য় খণ্ড)
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৭৬
প্রাককথন
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ছেলে-মেয়ে উভয়ে বুঝে পায় না তার রোল মডেল কে হবে। মুসলিম মেয়েরা তথাকথিত কোনো প্রতিষ্ঠানের বড় পদধারী সুশীল মহিলাকে রোল মডেল দাঁড় করিয়ে নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিতে চায়। কিন্তু যে মুসলিম নারীর চূড়ান্ত লক্ষ্য জান্নাতুল ফিরদাউস, তার কি এমন যাকে-তাকে রোল মডেল বানালে চলবে? কখনোই না। তার রোল মডেল হবেন তো সেই জান্নাতুল ফিরদাউসের নারী নেত্রীরা। আমাদের জন্য তাই অনুসরণীয় হলেন সেই চার মহীয়সী নারী- হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, মারিয়াম আলাইহিস সালাম, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও আছিয়া আলাইহিস সালাম।
বই সম্পর্কে
উসমানী খিলাফতকালে মিশরের কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন শাইখ আবদুর রউফ আল-মুনাবি। এই বিগদ্ধ আলেমের লেখায় উঠে এসেছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতেমাতুজ জাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহার মহিমান্বিত জীবনগল্প।
বিশুদ্ধ মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে অর্থাৎ তাঁর ৩৫ বছর বয়সে আম্মাজান খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার কোল আলো করে আসেন ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তাই শৈশবে যখন তাঁর মহান বাবা নবুয়ত লাভ করেন, তারপর থেকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় বেড়ে ওঠেন এই মহীয়সী নারী। যাঁর পিতা সর্বশ্রেষ্ঠ মানব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যাঁর মা প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিনী, বিদুষী ও পবিত্রা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা, তিনি যে এক অনুপম মানবী হবেন- এটা বলার আর দরকার পড়ে না।
ছোটবেলা থেকেই ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা দেখিয়েছেন ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা। শিআবে আবু তালিব অর্থাৎ সামাজিক বয়কটের বেদনাবিধুর ৩ বছর, আপন বাবার উপর কুরাইশদের অত্যাচার, ছোটবেলায় আপন মাকে হারানো, একের পর এক ভাইবোনের মৃত্যু- এতো কষ্ট তিনি ধৈর্য ধরে সহ্য করে গিয়েছেন। কুরাইশরা যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মাটি নিক্ষেপ করত আর তিনি সেভাবে মাটি মাখা অবস্থায় বাড়ি ফিরতেন, তখন ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজ বাবার মুখ থেকে মাটি মুছে দিতেন আর ঝরঝর করে কাঁদতেন। যেদিন কতিপয় নরাধম কুরাইশ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিজদাবনত অবস্থায় তাঁর উপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়, তখনও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা দৌঁড়ে যান। অকুতোভয় এই নারী বাবার উপর থেকে সেই জঞ্জাল সরিয়ে এহেন হীন কাজ করা কুরাইশদের উচিত কথা শুনিয়ে দেন। বাবার প্রতি এমন ভালোবাসা ও মমতার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ডাকতেন "উম্মে আবিহা"। অর্থ বাবার মা।
এই মহান নারী ছিলেন দুনিয়ার প্রতি একদম নিরাসক্ত। তাঁকে কাজে সাহায্য করার জন্য কোনো গৃহ পরিচারিকা ছিল না। নিজ হাতে যাতায় আটা পিছতে পিছতে হাতে কড়া পড়ে। কলসে করে পানি আনায় গলায় ও কোমরে পড়ে দাগ। একবার দাসী চাইতে বাবার কাছে গেলে লজ্জাবতী ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রয়োজনের কথা লজ্জায় আর বলতে পারেন না। আরেকবার গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দাসী না দিয়ে নসীহত করেন যে ঘুমানোর আগে ৩৩ বার সুবহান আল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ আর ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়তে। এটা দুনিয়ায় দাসী পাওয়ার চেয়েও বহুগুণে উত্তম। এমন উপদেশে রুষ্ট হওয়া দূরের কথা, এই কথায় ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজের সন্তুষ্টি জানিয়ে ফিরে আসেন। দৈন্য ছিল তাঁর ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সংসারের নিত্যসঙ্গী। তবুও এ নিয়ে কোনো দাম্পত্যকলহ ছিল না। স্বামী-সন্তানের প্রতি নিজ দায়িত্ব তিনি সুচারুভাবে পালন করেছেন।
শুধু এটুকুই নয়। ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন একজন বিদুষী নারী। উহুদ যুদ্ধে যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুরুতর আহত হন, তখন ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর সেবা করেন। নিজ মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে চিকিৎসা করে তাঁর বাবার দেহের রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন। তাছাড়া তাঁর পাণ্ডিত্যের দেখা মেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করা বিরহমাখা কবিতায়।
প্রাণাধিক বাবার মৃত্যুর পরে ভেঙে পড়েন ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের ছয় মাস পর তিনিও দুনিয়া ত্যাগ করেন। এই মহীয়সী নারীর প্রয়াণও শিক্ষনীয় হয়ে রয়েছে। তাঁর অবয়ব অবধি যেন কোনো পরপুরুষ বুঝতে না পারে তাই আসমা বিনতু উমাইস রাদিয়াল্লাহু আনহার খেজুর পাতা দিয়ে বানানো একধরনের মশারী ও চাদরে আবৃত করে তাঁকে রাতের আঁধারে দাফন করা হয়। এটা ছিল তাঁর অসিয়ত। মহীয়সী ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুও তাই ছিল মহান।
এইসব কথায় ইতিহাস থেকে তুলে এনে কলমের আঁচড়ে লিখে গিয়েছেন শাইখ আবদুর রউফ আল-মুনাবি তাঁর বক্ষ্যমান বইয়ে। সাবলীল ভাষায় চিত্রায়িত করেছেন জান্নাতের নারী সর্দারনির কালজয়ী জীবনী।
পাঠ্যানুভূতি
আমাদের মুসলিমাহদের রোল মডেল ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার জীবনী নিয়ে এটায় আমার পড়া প্রথম বই। মানে এভাবে কেবল ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিয়ে আলাদা করে এক মলাটে আগে কিছু পড়া হয়নি। যা পড়েছিলাম তা হয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী পড়তে গিয়ে অথবা অন্য কোনো বিষয়ের বই বা লেখা পড়তে গিয়ে পড়া।
নিছক ইতিহাসের বই পড়া আসলেও কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু এই জায়গায় শাইখ আবদুর রউফ আল-মুনাবিকে ব্যতিক্রম পেলাম। বইয়ে কেবল কিছু কাটখোট্টা তারিখ, সাল নেই। বরং ঘটনাপ্রবাহ এমন সুন্দরভাবে পরপর সাজানো যে তরতর করে পড়ে ফেলা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই অনুবাদক মুফতি আবদুল্লাহ আল মামুন কাসেমির তারিফ করতে হয়। কারণ তিনি যদি মুন্সিয়ানার সাথে বইয়ের অনুবাদ না করতেন তবে এটা নিরস ইতিহাসের বইই হয়ে যেত।
ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার জীবনী আমাকে ভাবিয়েছে। আমার ভিতর নাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর শুভ্রসফেদ জীবনের বিভিন্ন ঘটনা। যেমন তাঁর পর্দা করা ও পরপুরুষের চোখের অন্তরালে থাকার dedication। তা এমনই যে হাদিসে এসেছে, কিয়ামতের দিন এক ঘোষক ঘোষণা দিয়ে তাবৎ মানুষকে চোখ বন্ধ করতে বলবে আর তখন ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সত্তর হাজার অপ্সরী নিয়ে বিদ্যুৎ বেগে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তিনি হবেন প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী।
তাছাড়া বইটার অধ্যায় বিন্যাস খুবই গুছানো। ইতিহাসের মাঝে মাঝে যেই বানোয়াট ঘটনা সমাজে প্রচলিত সেগুলোর অসারতা নিয়েও লিখতে ভুলে যাননি লেখক। লেখায় প্যাঁচগোজ নেই। সাল, তারিখ আর নাম দিয়ে গাদাগাদি নেই। পরিপাটিভাবে লেখা এক অনবদ্য বই এটা।
বইটার প্রচ্ছদও মেয়েদের চোখে পড়বে এমন রঙের। মাখোমাখো গোলাপী। মাশা আল্লাহ। তবে হ্যাঁ, বইয়ে দুই-তিন জায়গায় বানান ভুল চোখে পড়েছে। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে এগুলো ঠিক করা হবে ইংশা আল্লাহ।
নিজেদের রোল মডেলদের চিনে নিতে ও আপন জীবন পরিচালনার এক কল্যাণকর দিশা পেতে অবশ্যই সব বোনদের পড়া উচিত দারুত তিবইয়ানের "মহীয়সী নারী সিরিজ"। আর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার জীবনী নিয়ে লেখা খণ্ডটা must read। কেবল মুসলিম বোনদের প্রতিই পড়ার আহবান থাকছে না। আমি মুসলিম ভাই ও অমুসলিম সব ভাইবোনকে এই মহীয়সী নারীর জীবনীগ্রন্থ পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কারণ ইসলামে নারীর সম্মানের স্বাক্ষ্য দেয় ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার জীবনী।
Comments
Post a Comment