বই রিভিউ #১৩
বই: পাইন বনের যোদ্ধা
লেখক: ইমরান রাইহান
বইঃ পাইন বনের যোদ্ধা
লেখকঃ ইমরান রাইহান
প্রকাশকঃ সঞ্চালন প্রকাশনী
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৪৪
ইউরোপের পোপ হিসেবে নির্বাচিত হয় দ্বিতীয় আরবান। দায়িত্ব পেয়েই তিনি মন দেন তাঁর বহুদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। মুসলিমদের থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে বায়তুল মাকসিদ। কিন্তু এই ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে তিনি হাতিয়ার বানান ইউরোপবাসীর ধর্মীয় আবেগকে। হাজারো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ফ্রান্সে এক বিরাট সমাবেশে সর্বস্তরের খ্রিস্টানদের ক্ষেপিয়ে দেয় জেরুজালেমের মুসলিমদের ও সব মুসলিমদের বিরুদ্ধে। সবাইকে দেখায় অঢেল জমিজমার এবং পোপের স্বাক্ষরিত স্বর্গের প্রতিশ্রুতিপত্র পাওয়াড় লোভ। জনগণ ফুঁসে ওঠে। এভাবেই প্রজ্জ্বলিত হলো প্রথম ক্রুসেডের আগুন ইউরোপবাসীর অন্তরে। যাকে বলে ধর্মযুদ্ধ।
পিটার দ্য হারমিট শুরু করে পুরো ইউরোপ ঘুরে ঘুরে লোকবল জড়ো করা। দলে ছিল কৃষক শ্রেণীর গ্রামের সাদাসিধে লোকজন। যাদের স্বপ্নে ছিল এক দেশ যার নাম জেরুজালেম। সে দেশ সবুজ, শস্য-শ্যামলে ভরপুর, যেখানে গেলে ঘুচবে দারিদ্র্য। আর মারা পড়লে পাওয়া যাবে স্বর্গ। ওয়াল্টার নামের আরেকজন যাজকও এভাবে বাহিনী তৈরি করে। কিন্তু কেউ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নয়। তাই প্রথমবার কিলিজ আরসালানের রাজধানী নিকিয়া আক্রমণে পরাজয় বরণ করতে হয়।
সেলজুক সুলতান কিলিজ আরসালানের রাজধানী নিকিয়ায় হামলা করে ক্রুসেডাররা এক পাইন বন পার হয়ে। প্রথম আক্রমণের পথে এই পাইন বন থেকে আসার কথা সামনে রেখে বইয়ের নাম হয়েছে "পাইন বনের যোদ্ধা"।
এবার সময় নিয়ে পোপ দ্বিতীয় আরবানের আদেশ মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। এই প্রশিক্ষিত বাহিনী আর আগের মতো নয়। এগিয়ে যাচ্ছে তারা নিকিয়ার দিকে। ওদিকে কিলিজ আরসালান আছে রাজধানী থেকে ৯০০ কিমি দূরে। গাজি বিন দানিশমন্দের সাথে ঝামেলা তিনি মেটানোর জন্য গিয়েছেন। এখন রাজধানী কি হবে সুলতান ও তাঁর বাহিনী ব্যতীত? ক্রুসেডারদের আক্রমণে কি পতন হয়েছিল নিকিয়ার? ফলে পরিষ্কার হয়ে যায় জেরুজালেমে যাওয়ার পথ? সামনে এশিয়া মাইনর দিয়ে ঢুকতে হবে জেরুজালেমের দিকে।
এদিকে মুসলিম শাসকরা জড়িয়ে আছেন পারস্পারিক দ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্ব ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এদিকে ধেয়ে আসছে ক্রুসেডাররা। যেই শহরের পতন ঘটাচ্ছে, সেখানে চালাচ্ছে গণহত্যা। মুসলিমদের রক্তে ডুবে যাচ্ছে ক্রুসেডারদের ঘোড়ার হাঁটু। এই সঙ্গীন মূহুর্তে কি পবিত্র কালেমার পতাকা তলে এক হবে না মুসলিম শাসকেরা? কি হবে জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ? হবে না। কি হয়েছিল প্রথম ক্রুসেডের পরিণতি?
মুসলিমদের আশার নিভু নিভু প্রদীপের আলো বাড়াতে এসেছেন এক বীর। নাম তার মাওদুদ বিন তুনিতকিন। ছিনিয়ে আনতে পারবেন কি মুসলিমদের হাতছাড়া হওয়া অঞ্চলগুলো ক্রুসেডারদের থাবা থেকে? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পড়ে ফেলুন চমৎকার এই বই "পাইন বনের যোদ্ধা"।
পাঠ্যানুভূতিঃ
আরো আট-দশজন মুসলমানের মতো আমিও জানতাম না যে খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলের পর এই বর্তমানে আসার পথে ইসলামি ইতিহাসে ক্রুসেড নামের কোনো গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তারপর একদিন যখন জানতে পারি, তারপর থেকেই প্রবল ইচ্ছে ছিল ক্রুসেড নিয়ে পড়ার, জানার। "পাইন বনের যোদ্ধা" বইটার নাম অনেকবার শুনেছিলাম। তাই রিভিউ চেক করে বুঝে গেলাম আমার তো এই বইটাই চাই। তারপর আরকি কিনে পড়ে ফেললাম।
বইটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, যদিও বইটা নন-ফিকশন জনরার তবে এটা লেখা হয়েছে ফিকশনের আদলে। লেখক ইমরান রাইহান এই ব্যাপারে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন সেটা আমি বলতে পারি। ফিকশনের আদলে লেখা বলে পড়তে একটুও বিরক্তি ধরেনি। কিন্তু মাঝে হালকা রিডার্স ব্লকের ভাব আসায় আর একইসাথে আরো দুইটা বই পড়ায় শেষ করতে ১১ দিন লাগে। কিন্তু বইটা এক বসাতেই শেষ করার মতো।
ইতিহাসের বই তাও আবার ক্রুসেডের মতো এক ধর্মযুদ্ধ নিয়ে, সেখানে থ্রিলার পার্ট চলে আসে যখন দৃশ্যপটে আসে যুদ্ধের বিবরণ। সেগুলোও খুব চমৎকার ভাবে লিখেছেন লেখক। টানটান উত্তেজনা নিয়ে পড়েছি যুদ্ধের বিবরণ গুলো। মাঝে মাঝে নিজেই "ইয়েস" বলে উঠেছিলাম পড়তে গিয়ে। এতোই সাবলীল ও অসাধারণ হয়েছে যুদ্ধের দৃশ্য ও ঘটনার বর্ণনা।
লেখায় এক বা দুই জায়গায় বানান ভুল চোখে পড়েছিল। সেটা আহামরি বড় ব্যাপার না।
এবার আসি বইটার সম্বন্ধে আমার আরেকটা সবচেয়ে প্রিয় বিষয় নিয়ে। সেটা হলো বইয়ের প্রচ্ছদ। সবুজে-সবুজে ভরা প্রচ্ছদটা এতো সুন্দর, মাশা আল্লাহ এত্তো সুন্দর, যে কেউ যদি ইতিহাসের বই নাও পড়েন তবু বলব এই প্রচ্ছদ দেখতে কিনে ফেলেন। লস হবে না। এতো সুন্দর প্রচ্ছদ যে বলার বাইরে।
সবশেষে এটাই বলব, বইটার কভার যেমন মারাত্মক, ভিতরের ইতিহাসও তেমনই। যেটা সত্য ইতিহাস। যা পড়লে মনে হবে আরে এতো আজকের জামানায় সেই ১০৯৬ সালের আদলে। কিভাবে সম্ভব? একই ভুল করছে মুসলিম শাসকেরা, একইভাবে জেরুজালেম দখলের পায়তারা চলছে। জেরুজালেম সবার লোভের বস্তু, তিন আবরাহামিক ধর্মের উদ্ভবের পর থেকে।
বইটা পড়ে আপনি দুশ্চিন্তায় পড়বেন, খানিক আনন্দ পাবেন, ক্রুসেডারদের পাশবিকতায় শিউরে উঠবেন আর বার বার ভাববেন, এ যেন আজকের দিনের প্রতিচ্ছবি হাজার বছর আগের আয়নায়। কিংবা উল্টোটা।
Comments
Post a Comment