বই রিভিউ #১০
বই: উম্মুল মুমিনিন মহীয়সী খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
লেখক: মূল: ইবরাহিম মুহাম্মদ হাসান আল-জামাল
এনামুল করীম ইমাম
বই: মহীয়সী খাদিজা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)
লেখক: মূল: ইবরাহিম মুহাম্মদ হাসান আল-জামাল
এনামুল করীম ইমাম
প্রকাশক: দারুত তিবইয়ান
পৃষ্ঠা: ১৪৪
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হলেন একজন নারী। তৎকালীন আরবের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে যেই বিদুষী নারী সবসময় সুরক্ষিত রেখেছিলেন। দিকে দিকে যার গুণের কথা ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বকে সবাই চেনে, তিনি পেলেন এক সম্মানিত খেতাব, "আত-তাহিরা"। পবিত্রতমা।
নিজের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার বলে যেই নারী হয়ে উঠেছিলেন বাবার ব্যবসার দায়িত্বে এক যোগ্য উত্তরাধিকারী। প্রথম শাহাদাত পাঠকারিনী। সেই অনন্য নারী যার নাম খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)। মুসলিমদের প্রথম মা, উম্মাহাতুল মুমিনিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম স্ত্রী, তাঁর ছয় সন্তানের জননী, তাঁর দাওয়াতী মিশনের যোগ্যতম সহযোগী, তাঁর সহমর্মী।
তৎকালীন আরবের ধণাঢ্য পরিবারে এক ছেলের জন্মের পরে যখন অনেকদিন চলে যায় কোনো সন্তানের আগমনী সুখবর না পেয়ে, যখন বাবা খুয়াইলিদ ও মা ফাতেমা প্রায় আশা ছেড়েই দিবেন, ঠিক তখনই তাঁদের কোল আলো করে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। তার আগমনে সবার মনে লাগে উৎসবের আমেজ। না, তখনকার পাপে ভরা আরব সমাজের আর পাঁচটা বাবার মতো মুখ কালো হয়নি খুয়াইলিদের। মেয়ের নাম রাখেন খাদিজা।
খাদিজা বেড়ে উঠতে থাকেন নিজস্ব জ্যোতির সাথে। সবাই বুঝতে পারে, এই মেয়ে আর পাঁচজনের মতো নয়। সমাজের সব পঙ্কিলতা এড়িয়ে চলে তিনি হয়ে ওঠেন সবার কাছে "আত তাহিরা" অর্থাৎ পবিত্রতমা।
বিয়ের উপযোগী হলে এই রূপবতী, গুণবতী নারীর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার) পাণিপ্রার্থীর অভাব পড়ে না। প্রথম সংসার পাতেন আবু হালা হিন্দার সাথে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর কারণে সেই সংসার টিকে না বেশিদিন। তখনও খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যুবতী। তাই অনেক ছাটাই-বাছাইয়ের পরে দ্বিতীয়বার বিয়ের কনে হন। দ্বিতীয় স্বামী আতিক ইবনু আবিদের সাথে সংসার ভাঙার পরে সিদ্ধান্ত নেন যে আর সংসার ধর্মে জড়াবেন না। ধর্ম ও নিজ জগত নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন।
এদিকে বড় ছেলের মৃত্যুর পর চিন্তায় পড়েন খুয়াইলিদ। তাঁর এই গুছানো ব্যবসা কি এভাবেই বিলীত হয়ে যাবে? তখন তিনি বেছে নেন তাঁর বিচক্ষণ মেয়ে খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে সেই ব্যবসার হাল ধরার জন্য। খুয়াইলিদ একচুলও ভুল করেননি। নিজ বিচক্ষণতায়, সততায় খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বাবার ব্যবসাকে আরো বড় করেন। হয়ে ওঠেন একজন সফল ব্যবসায়ী।
এই বড় ব্যবসার দেখাশোনার জন্য একজন যোগ্য উজির নিয়োগ দেওয়া চায়। কিন্তু এমন সৎ মানুষের অভাব তো চিরকালই থাকে। বিচক্ষণ খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ঠিকই খুঁজে বের করলেন সেই যোগ্য মানুষটাকে। তিনি আর কেউ নন, আল-আমিন মানে খ্যাত, আমাদের প্রাণের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। দুটি শুভ্র হৃদয়ের পরিচয় হলো। তারপর?
......
"মহীয়সী খাদিজা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বইটা দারুত তিবইয়ান থেকে ২০২৩ এ প্রকাশিত "মহীয়সী নারী সিরিজ" এর অন্তর্ভুক্ত। সংক্ষিপ্তভাবে এই বইয়ে উঠে এসেছে খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার জীবনী। তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আছে বইয়ের পাতায় পাতায়। অবশ্য একেকটা অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল ব্যতিক্রমধর্মী।
খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার জীবন যেহেতু নবুওয়াতের প্রথমদিকের ঘটনার সাথে মিলেমিশে একাকার, তাই বইয়ে উঠে এসেছে আমাদের কিছু জানা, অনেক অজানা ব্যাপার। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ওহি নাজিলের পর খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার সমর্থনের বিভিন্ন ঘটনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াহ মিশন, আবিসিনিয়ায় ১৬ জন মুসলিমের প্রথম হিজরত, কুরাইশদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার, বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবকে সামাজিকভাবে বয়কটের ঘটনা ইত্যাদি। ছোট কলেবরে আমাদের মুসলিমদের মা, সেই অনন্য নারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)র জীবনী জানার জন্য বইটা অবশ্যই দারুণ।
পাঠ্যানুভূতি
গত বছর থেকেই ঠিক করেছিলাম যে ইসলামের পাতায় যেসব মহীয়সী নারীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা, তাঁদের জীবনী পড়ব। কারণ তাঁদের জীবনী থেকেই পাওয়া যাবে এই সংকটপূর্ণ সময়ে একজন প্রকৃত মুসলিমাহ হিসেবে চলার নির্ভুল গাইডলাইন। সেই অতি উৎসাহ আর আগ্রহ থেকেই ২৩ সালে admission phase এর মাঝেই আব্বু-আম্মুকে মানিয়ে এই "মহীয়সী নারী সিরিজ" কিনেছিলাম। কিন্তু নানান ব্যস্ততায় পড়া হয়েই উঠছিল না এই বইগুলো।
তো আলহামদুলিল্লাহ একটা বই পড়া হলো সিরিজটার। মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা আমার খুবই পছন্দের একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। বইটা পড়ে জানা হলেও মন খারাপ হয়েছে কিছুটা। অবশ্য কলেবর দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল। আর পাঁচটা জীবনীর মতো এই বইটা আসলে গবেষণাধর্মী জীবনীর বই না। তো কিছুটা disappointed।
তবুও সংক্ষিপ্ত হলেও বইটা মানুষ "খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা" কে তাঁর বিভিন্ন কাজ, কথা দিয়ে তুলে ধরেছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে চিনতে পারা, প্রথম যেদিন জিবরাইল আলাইহিস সালাম আসেন তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভয় পেয়ে গেলে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার সময় বলা কথাগুলো, জিবরাইল আলাইহিস সালাম আসলেও একজন ফেরেশতা কিনা সেটা পরীক্ষা করা,আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সালাম দিলে সেই সালামের জবাবে তাঁর শব্দচয়ন ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
বর্তমান মিডিয়ার অপপ্রচারে আমরা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে দেখি একজন সফল CEO হিসেবে। কিন্তু বাস্তবতা এমন ছিলই না। না, তিনি এখনকার মতো office এ গিয়ে 9-5 CEO হিসেবে বাবার ব্যবসা পরিচালনা করতেন আর না তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার পরেও এই ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন আমৃত্যু। সেই সত্য জানতে প্রতিটা মেয়ের পড়া উচিত এই বই।
বর্তমান যুগে মেয়েরা প্রচণ্ড বাজেভাবে ভুগছে যোগ্য "Role model" এর অভাবে। ভুলভাল ideology র মেয়েদেরকের আদর্শ বানিয়ে পড়ছে নানা বিচ্যুতির কবলে। কিন্তু মুসলিম নারীর আদর্শ তো প্রকৃতপক্ষে সেই নারীরায় যাঁরা আল্লাহর কাছে পেয়েছেন স্বীকৃতি, পেয়েছেন জান্নাত লাভের সুসংবাদ, হয়ে উঠেছেন আল্লাহর ওলী। আর অবশ্যই তাঁদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ হলেন জান্নাতী চার নারী সর্দার। তাই নিজেকে গড়তে সেই এক জান্নাতী নারী সর্দারের জীবনীতেই পাওয়া যাবে প্রত্যেক মুসলিম নারীর জন্য সর্বোত্তম পাথেয়, দিকনির্দেশনা।
তাই সব বোনকে বলব এই ছোট বইটা পড়ে ফেলতে। যেখানে উঠে এসেছে উম্মাহাতুল মুমিনিন খাদিজা আত তাহিরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য জীবনের একেকটা ঘটনার বাঁকে বাঁকে।
Comments
Post a Comment